জীবনানন্দ দাশের রোমান্টিক প্রেমের কবিতা (জনপ্রিয় ভালোবাসার কবিতা)

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম একজন জনপ্রিয় কবি হচ্ছেন জীবনানন্দ দাশ। তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি। তার কবিতাগুলোর মধ্যে প্রেমের কবিতা অনেক জনপ্রিয়। অনেকেই জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা খুজে থাকেন। যদি আপনি জীবনানন্দ দাশের রোমান্টিক কবিতা জানতে চান তাহলে এই পোস্ট আপনার জন্য। 


এই পোস্টে জীবনানন্দ দাশের জনপ্রিয় সকল রোমান্টিক প্রেমের কবিতা দেয়া হবে। আপনারা জীবনানন্দ দাশের সকল প্রেম নিয়ে কবিতা এখানে পড়তে পারবেন। এখানে দেয়া জীবনানন্দ দাশের রোমান্টিক প্রেম/ ভালোবাসা নিয়ে সকল কবিতা আপনাদের ভালো লাগবে। তার বিখ্যাত সকল প্রেমের কবিতা জানতে সম্পূর্ণ পোস্ট পড়তে ভুলবেন না-


জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা


জীবনানন্দ দাশের প্রেমের ও রোমান্টিক কবিতাঃ

জীবনানন্দ দাশ ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি, লেখক ও প্রাবন্ধিক। এছাড়াও বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। জীবনানন্দ দাশ মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্মশতবার্ষিকী পালিত হওয়ার পূর্বেই তিনি বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবি হয়েছিলেন। 


জীবনানন্দ দাশ তার কাব্যে গ্রাম বাংলার রূপকথা ও সৌন্দর্য খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। এই কারণে তাকে রূপসী বাংলার কবি বলা হয়। এছাড়াও বুদ্ধদেব বসু তাকে নির্জনতম কবি বলেছেন। আবার অনেকেই তাঁকে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি বলে মনে করেন। জীবনানন্দ দাশের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থগুলোর মাঝে রয়েছে রূপসী বাংলা, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, বেলা অবেলা কালবেলা, শ্রেষ্ঠ কবিতা ইত্যাদি৷ 


তবে জীবনানন্দ দাশ তার মৃত্যুর পূর্বে তিনি ২১টি উপন্যাস এবং ১২৬টি ছোটগল্প রচনা করেছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে একটিও তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি৷ অনেক দরিদ্রতায় তিনি জীবন অতিবাহিত করেছেন। অর্থের প্রয়োজনে তিনি কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন ও প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি তার অনেক গল্প এবং উপন্যাস প্রকাশের ব্যবস্থা নেন নি। ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবরে কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন। অতঃপর ১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর কলকাতার শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। 

আরো জানুনঃ জনপ্রিয় সকল প্রকৃতি নিয়ে কবিতা

জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতাঃ 

জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করেছেন। তার কবিতাগুলোর মধ্যে প্রেমের কবিতাগুলো অনেক জনপ্রিয়। জীবনানন্দ দাশের প্রেম নিয়ে কবিতা মানুষের ভালো লাগে। নিম্নে জীবনানন্দ দাশের প্রেমের জনপ্রিয় সকল কবিতা দেয়া হলো- 


দুজন 

(জীবনানন্দ দাশ - বনলতা সেন)


আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে

খুঁজি নাকো;- এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলোপৃথিবীর পারে

আমরা দুজনে আছি; 

পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,

প্রেম ধীরে মুছে যায়, 

নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়,

হয় নাকি?’- বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে;

আজ এই মাঠ সূর্য সহধর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে

প্রাণ তার ভরে গেছে।


দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে

আবার প্রথম এল-মনে হয়- যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে।

লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে

অন্ধকারে নড়ে- চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে;

তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল;


যেখানে আকাশে খুব নীরবতা,শান্তি খুব আছে,

হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ

আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে:

সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারিদিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে

হেমন্ত আসিয়া গেছে;-চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি;

ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের নেই আর দেরি,

হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে;

ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে।

নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,

জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়

কী নিয়ে থাকিবে বলো; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,

তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না

হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা

ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’

এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে

উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর।

হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়

চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;

চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–


প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে

যেখানে রবো না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,

কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে — বাসনার মতো ভালোবাসা

খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।’ 


অদ্ভুত আঁধার এক 

(জীবনানন্দ দাশ) 


অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,

যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;

যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই – 

প্রীতি নেই – করুণার আলোড়ন নেই

পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।

যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়

মহত্‍‌ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা

শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়। 


শঙ্খমালা 

(জীবনানন্দ দাশ - বনলতা সেন) 


কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে

সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,

বলিল, তোমারে চাই:

বেতের ফলের মতো নীলাভ ব্যথিত তোমার দুই চোখ

খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি- কুয়াশার পাখনায়- 


সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলোক

জোনাকির দেহ হতে-খুজেছি তোমারে সেইখানে-

ধূসর পেচার মতো ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে

ধানসিড়ি বেয়ে-বেয়ে

সোনার সিঁড়ির মতো ধানে আর ধানে

তোমারে খুঁজছি আমি নির্জন পেঁচার মতো প্রাণে।


দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;

সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা-

বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,

শিঙের মতন বাঁকা নীল চাঁদ শোনে যার স্বর।


কড়ির মতন সাদা মুখ তার;

দুইখানা হাত তার হিম;

চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম

চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা 

শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায় সে আগুনে হায়।

চোখে তার যেন শত শতাব্দীর নীল অন্ধকার!


স্তন তার করুণ শঙ্খের মতো – 

দুধে আর্দ্র-কবেকার শঙ্খিনীমালার!

এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর। 


বনলতা সেন 

(জীবনানন্দ দাশ - বনলতা সেন)


হাজার বছর ধরে আমি পথ 

হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের 

অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি; 

বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি; 

আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, 

চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিলো 

নাটোরের বনলতা সেন।


চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,

মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; 

অতিদূর সমুদ্রের ’পর

হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা

সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে 

চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,

তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে , 

‘এতোদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মত চোখ 

তুলে নাটোরের বনলতা সেন।


সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন

সন্ধ্যা আসে; 

ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে 

পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;

সব পাখি ঘরে আসে — 

সব নদী- ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;

থাকে শুধু অন্ধকার, 

মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। 


জীবনানন্দ দাশের রোমান্টিক কবিতাঃ 


আকাশলীনা 

(জীবনানন্দ দাশ - সাতটি তারার তিমির) 


সুরঞ্জনা, ঐখানে যেয়োনাকো তুমি,

বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;

ফিরে এসো সুরঞ্জনা:

নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;


ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;

ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;

দূর থেকে দূরে – আরও দূরে

যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।


কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে!

আকাশের আড়ালে আকাশে

মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:

তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।


সুরঞ্জনা,

তোমার হৃদয় আজ ঘাস :

বাতাসের ওপারে বাতাস -

আকাশের ওপারে আকাশ। 


কুড়ি বছর পরে 

(জীবনানন্দ দাশ - বনলতা সেন)


আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি!

আবার বছর কুড়ি পরে-

হয়তো ধানের ছড়ার পাশে

কার্তিকের মাসে-

তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী

নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে!


অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর,

ব্যস্ততা নাইকো আর,

হাঁসের নীড়ের থেকে খড়

পাখির নীড়ের থেকে খড়

ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, 

শীত আর শিশিরের জল!


জীবন গিয়েছে চলে আমাদের 

কুড়ি কুড়ি বছরের পার-

তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই 

আমি তোমারে আবার!

হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে 

একরাশ পাতার পিছনে

সরু সরু কালো কালো 

ডালপালা মুখে নিয়ে তার,

শিরীষের অথবা জামের,

ঝাউয়ের-আমের;

কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!


জীবন গিয়েছে চলে আমাদের 

কুড়ি কুড়ি বছরের পার-

তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!


তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে

 বাবলার গলির অন্ধকারে

 অশথের জানালার ফাঁকে

 কোথায় লুকায় আপনাকে!

চোখের পাতার মতো নেমে চুপি চিলের ডানা থামে-


সোনালি সোনালি চিল-শিশির 

শিকার করে নিয়ে গেছে তারে-

কুড়ি বছরের পরে সেই 

কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে!  


এই ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা। উপরে জীবনানন্দ দাশের জনপ্রিয় কিছু প্রেম/ ভালোবাসা নিয়ে কবিতা দেয়া হয়েছে। তবে এগুলো ছাড়াও জীবনানন্দ দাশ প্রেম/ ভালোবাসা নিয়ে আরো কবিতা লিখেছেন। এই পোস্টে নিয়মিত আরো জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা যুক্ত করা হবে। 

আরো পড়ুনঃ জীবনানন্দ দাশের প্রকৃতি নিয়ে কবিতা

উপসংহারঃ 

জীবনানন্দ দাশের প্রেমের কবিতা নিয়ে এই পোস্ট আপনাদের কেমন লাগলো কমেন্টে জানাবেন। এছাড়াও যদি জীবনানন্দ দাশের প্রেম/ ভালোবাসা নিয়ে আরো কবিতা চান তাহলে কমেন্টে জানাতে পারেন। আমরা আপনাদের জন্য জীবনানন্দ দাশের সেরা প্রেমের কবিতাগুলো এখানে নিয়মিত যুক্ত করব। বিভিন্ন কবিতা নিয়ে এরকম পোস্ট সবার আগে পেতে আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক, ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব ও গুগল নিউজে ফলো করে পাশে থাকুন।

Share This Article On:

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url